Wednesday, May 30, 2012

মুক্তিযুদ্ধ; নতুন প্রজন্মের ভাবনা


‘‘আমার বয়স তখন সবে মাত্র ছয় বছর,সারা দেশে যুদ্ধ চলছে। আমার গ্রামের বাড়ি ছিল কুমিল্লা’র বাঞ্ছারামপুরে। বাবা ও চাচারা বঙ্গবন্ধুর ডাকে দেশ স্বাধীন করার জন্য  যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। আমার পরিবারে আমি ছাড়া কোন পুরুষ মানুষ ছিলনা। আমি ছিলাম মাত্র ছয় বছরের এক বালক, কিন্তু আমার কাধেই দায়িত্ব পরল আমার মা ও খালাকে নিয়ে পাশের গ্রামে পালিয়ে যাওয়ার। আসলে দায়িত্ব বললে ভুল হবে, ব্যাপারটা এই ভাবেও বলা যায়, আমার মা আমাকে এবং আমার খালা কে নিয়ে আমাদের গ্রামের আর সব মানুষের সাথে পাশের গ্রামে পালিয়ে যাচ্ছিলেন। আমাদের সাথে আরও প্রায় হাজার দুয়েক মানুষ ছিল।
আমার মাথায় তখন আমার মা’র একটি ট্রাঙ্ক/বাক্স ছিল, আমরা তিনজন কখনও হেটে কখনও বা দৌড়ে যতটা সম্ভব ছুটে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় আছি। আমার খালা’র বয়স তখন আঠার। আমাদের পাশের পাড়া’র কিছু মানুষ্‌ যারা তখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দালাল হিসেবে কাজ করছিল। এক কথায় জামাত’র কিছু পোষা কুত্তা যারা ইতোমদ্ধেই রাজাকার,আলবদর হিসেবে বেশ সুনাম অর্জন করেছিল আর কি!
সেই নরপিচাশ রাজাকারদের চোখ পরল আমার খালা’র উপর এবং তারা আমাদের দিকে ধেয়ে আসতে শুরু করল। ভয়ে তখন আমার পা কাপছে, গা শিউরে উঠছে শুধু এই ভয়ে, কখন আমার খালাকে ধরে নিয়ে যায়!! খালা তখন রাজাকার গুলোর হাত থেকে বাচার জন্য প্রানপনে ছুটে বেরাচ্ছেন, পালিয়ে বাচার আশায়। কিন্তু নিয়তির কাছে হার মেনে নিয়ে খালা অবশেষে কুকুর গুলোর হাতে ধরা পরে এবং খালাকে নিয়ে যাওয়া হয় হানাদার বাহিনীর কাম্পে। খালার উপর কতটা নির্যাতন চলেছিল ওই বয়সে হয়ত বুঝতে পারিনি, কিন্তু আজও সেই কথা মনে পরলে খুব কান্না পায়! কতটা অত্যাচার সহ্য করেছিলেন আমার খালা, কি নির্মমভাবে তার উপর পাশবিক অত্যাচার করেছিল হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোষররা।
শুধু খালাকে ধরে নিয়েই সেদিন খান্ত হয়নি সেই পশুগুলো। এমনকি আমার মাথা থেকে ট্রাঙ্ক নামিয়ে বন্দুকের বাট দিয়ে তালা ভেঙ্গে ট্রাঙ্কে থাকা আমার মা’র জমানো টাকা ও গয়না গুলোও নিয়ে গিয়েছিল। আমার দিকে যেই ভয়ঙ্কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল সেই চাহনি আমি আজও ভুলতে পারিনি! যাই হোক, দেশ স্বাধীন হল । স্বাধীনতার ৩৮ বছর পরও সেই লোক গুলো যারা কিনা এদেশেরই মা ও মাটির সাথে বেঈমানী করল আজ তারা বহাল তবিয়তে স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে ঘুরে বেরায়; লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে আসে! অবশ্য যুদ্ধাপরাধের বিচারকার্য শুরু হয়ে যাওয়ার পর তাদেরকে আর কখনই এলাকায় দেখিনি! আমার এই বয়সে এসে আর তেমন কিছুই চাওয়ার নেই। শুধু এইটুকু চাই, মৃত্যুর আগে যেন এই নরপিচাশ গুলোর বিচার দেখে একটু শান্তি নিয়ে মরতে পারি’’
কথা গুলো বলছিলেন ৪০ পেরিয়ে যাওয়া একজন মানুষ, যিনি নিজে একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, এবং উপরিউক্তু ঘটনার সেই ৬ বছরের বালক, যার জীবনের  পরতে পরতে মুক্তিযুদ্ধের বাস্তবতা ও পরবর্তী সময়ের ইতিহাস জড়িত, যিনি পেরিয়ে এসেছেন জীবনের এ্তগুলো বছর। কথাগুলো বলার সময় চোখ ছল ছল করছিল মানুষটির। আমার দুর্ভাগ্য মানুষটির নাম জেনে নিতে পারিনি, তবে নাম দিয়ে কি হবে! আমি নিজেইতো নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি তখন, কখন নিজের অজান্তেই চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পরেছে খেয়াল করিনি! কল্পনায় ডুবে  গিয়েছিলাম, মনে হচ্ছিল আমি সেই ৬ বছরের বালক এবং আমার খালাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে পাকি কুকুরগুলোর পোষা চামচা গুলো!
আমি ও আমরা বিশেষ করে আমাদের প্রজন্মের যারা আছি, আমাদের ওই সময়টাতে জন্ম হয়নি, আমরা সামনে থেকে দেখতে পারিনি সেই বর্বর অত্যাচারের দৃশ্য গুলো কিংবা দেখতে পারিনি দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধের পথ ধরে, ৩০ লক্ষ শহীদের রক্ত ও ৩ লক্ষ মা-বোনের ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত সেই বহু কাঙ্ক্ষিত বিজয়। আমরা ছিলামনা বলেই দেখতে পারিনি, কিন্তু আমাদের মনের ভেতর দেশের জন্য এক অদ্ভুত মমতা কাজ করে, যেমনটা ভালোবাসি আমরা আমাদের মায়েদের, ঠিক তেমন করেই দেশটাকে ভালবাসতে শিখেছি আমরা, দেশের জন্য যে কোন মুহূর্তে প্রাণ দিতে দিধাবোধ করব না হয়ত। ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে আমরা উল্লাসে উৎফুল্ল হয়ে যাই কিংবা ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় উৎসব করি। উপলব্ধি করার চেষ্টা করি, কতটা আত্মত্যাগ, কত রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের আজকের এই স্বাধীন বাংলাদেশ।
মূসা ইব্রাহিম,এম এ মুহিত কিংবা নিশাত মজুমদার ও ওয়াস্ফিয়া নাজরীনরা যখন হিমালয় পর্বতমালা জয় করে বাংলাদেশের পতাকার মর্যাদা উচিয়ে ধরে। সাকিব-আল-হাসান, মাশরাফি-বিন-মুর্তজারা ক্রিকেটে আমাদের দেশকে বিজয় উৎসব উপহার দেয়। সত্যি করে বলছি, আমরা, আমাদের প্রজন্মের কিশোর- কিশোরী, তরুন-তরুনীরা তখন বিজয় উল্লাসে মত্ত হয়ে দিশেহারা হয়ে যাই। বাংলাদেশের; আমাদের মা ও মাটির পতাকা উঁচিয়ে ধরি আকাশে, বুক ফাটিয়ে চিৎকার করে সারা পৃথিবীকে বলতে ইচ্ছে করে তখন, দেখে যাও আমরা আমাদের দেশটাকে, আমাদের মা ও মাটিকে কতটা ভালবাসি; কতটা ভালবাসতে শিখেছি!
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে যেই পতাকা নিয়ে আমরা উল্লাসে মেতে উঠি, ঠিক যখন দেখি কোন কোন রাজাকার/আলবদরের গাড়িতে আমাদের পতাকা শোভা পাচ্ছে, তখন রক্ত মাথায় উঠে যায়, আমি উম্মাদ হয়ে যাই; আমার রাস্ট্রদ্রোহী হয়ে যেতে ইচ্ছে করে! আমি ভাবতে পারিনা কি করে এতটা বেঈমান হয়ে যেতে পারি আমরা; কি করে ৩০ লক্ষ তাজা প্রানের আত্মত্যাগ ভুলে গেলাম আমরা ! আশার কথা হল সেই সব জানোয়ারদের বিচারকার্য এখন শুরু হয়েছে। আমরা এই বিচারের শেষ দেখতে চাই, আমরা দেখতে চাই জানোয়ার গুলো পাগলা কুকুরের মত ঘেউ ঘেউ করে মারা যাচ্ছে।
শুধু এইটুকু বলতে চাই, আমরা বিজয় দেখিনি; মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, তবে বুঝতে শিখেছি বাঙ্গালী জাতীর সবচেয়ে গর্ব করার জায়গাটি হচ্ছে মুক্তির সংগ্রাম। তাই আমরা মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারন করে, আধুনিক বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে কাজ করতে চাই(আমাদের প্রজন্ম)। আমরা যুদ্ধাপরাধের বিচারের শেষ দেখে আরও একটি বিজয়োল্লাসে মেতে উঠতে চাই। আমরা চাইনা কোন রাজাকার/আল-বদর এই দেশের মন্ত্রী হোক কিংবা মহান জাতীয় সংসদের পবিত্রতা নষ্ট করুক http://warhistoryofbangladesh.blogspot.com/

https://www.facebook.com/groups/tumurs/225748860877705/?notif_t=group_activity

No comments:

Post a Comment

আরো জানুন

সম্পর্কে