Sunday, May 27, 2012

বিএনপি যদি জামায়াতকে পরিত্যাগ না করে...

আমার এই লেখাটি কারোরই খুব গুরুত্ব দিয়ে পড়ার প্রয়োজন নেই, কারণ যে বিষয় নিয়ে লিখছি আমি তার বিশেষজ্ঞ নই। প্রশ্ন উঠতেই পারে তাহলে আমি লিখছি কেন? সেই প্রশ্নের উত্তরও আমি একটা দাঁড় করিয়ে রেখেছি: সবকিছুই কি বিশেষজ্ঞদের চোখে দেখতে হয়? একটা বিষয় সাধারণ মানুষ কেমন করে দেখে, সেটাও কি অন্যদের জানার কৌতূহল হওয়া উচিত না?
আমার ভণিতা দেখে সবাই নিশ্চয়ই অনুমান করে ফেলেছেন আমি দেশের রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে যাচ্ছি। এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগ দেশ চালাচ্ছে (শুদ্ধ করে বলা উচিত চৌদ্দ দল, কিন্তু আগেই বলেছি লেখাটা খুব গুরুত্ব দিয়ে পড়ার প্রয়োজন নেই, এখানে অনেক ভুল-ভাল থাকবে।) দেশটা কেমন চলছে সেটা নিয়ে সবারই নিজস্ব চিন্তাভাবনা আছে, আমারও আছে। আমাদের দেশের এত রকম সমস্যা তার সবকিছু ম্যানেজ করে কোনো সরকার পাঁচ বছর টিকে থাকতে পারলেই আমি তাকে পাস মার্ক দিয়ে দিই। টিকে থাকার সাথে সাথে যদি সরকার শিক্ষার ব্যাপারটা দেখে তাহলে আমি তাকে এ প্লাস দিতে রাজি আছি। (তার কারণ এই পৃথিবীতে যতগুলো দেশ তাদের সমস্যা মিটিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াতে পেরেছে তারা সবাই সেটা করেছে শুধু শিক্ষাটাকে ব্যবহার করে।) আমি মনে মনে খুব আশা করেছিলাম এই সরকার শিক্ষার জন্য আরও টাকাপয়সা খরচ করবে, করল না! বাংলাদেশের শিক্ষার পেছনে খরচ করার কথা জিডিপির ছয় ভাগ, এই সরকার খরচ করে মাত্র ২.৪ ভাগ। পৃথিবীর আর কোনো সভ্য দেশ শিক্ষার পেছনে এত কম টাকা খরচ করে বলে আমার জানা নেই। সবাই পদ্মা ব্রিজ, উড়াল সেতু, পরিবেশ—এসব নিয়ে কথা বলে, কিন্তু যদি শুধু শিক্ষার জন্য আর অল্প কিছু টাকা বেশি খরচ করত তাহলে এই দেশ যে কী ম্যাজিক হয়ে যেত সেটা কেউ বুঝল না—আহা রে!
তবে আমার দীর্ঘশ্বাস বুকে চেপে রেখে আমি এই সরকারকে শুধু এ প্লাস নয় গোল্ডেন এ প্লাস দিয়ে দেব যদি তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারটা ঠিকঠিকভাবে করতে পারে। ঠিকঠিকভাবে বলতে আমি কী বোঝাচ্ছি? বিষয়টা খুবই সহজ, যাদের ধরা হয়েছে আমাদের প্রজন্ম তাদের সবাইকে চেনে, আমাদের চোখের সামনে একাত্তরে তারা সেই ভয়ংকর কাজগুলো করেছে, কাজেই ট্রাইব্যুনাল যদি তাদের দোষী প্রমাণ করে শাস্তি দিতে পারে তাহলে আমরা বলব ঠিকঠিকভাবে বিচার হয়েছে। যদি দেখা যায় বিচারকাজে অবহেলার কারণে শেষ পর্যন্ত ফাঁকফোকর দিয়ে এই যুদ্ধাপরাধীগুলো বের হয়ে গেছে তাহলে আমরা বুঝব ঠিকঠিকভাবে বিচার হয়নি। (যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা মনে হলেই আমার একজন মানুষের কথা মনে পড়ে। সেক্টর কমান্ডারদের একটা মানববন্ধনে মানুষটি হিংস্র গলায় আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, আমার বাবাকে তো তারা বিচার করে মারেনি, তাহলে তাদের শাস্তি দেওয়ার জন্য আমাদের কেন বিচার করতে হবে? আমি জানি এই যুক্তি ট্রাইব্যুনালকে দেওয়া যাবে না; কিন্তু কথাটি আমি কখনো ভুলতে পারি না।)
এই দেশে এখন যতগুলো অসমাপ্ত বিষয় আছে তার মাঝে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীর বিচার। একাত্তরের নৃশংসতাটি যে কী ভয়ংকর ছিল নতুন প্রজন্ম সেটি কোনো দিন অনুভব দূরে থাকুক কল্পনাও করতে পারবে না। শুধু নতুন প্রজন্ম নয়, পৃথিবীর অন্য দেশের মানুষও সেটি চিন্তা করতে পারবে না। সেই নৃশংসতায় যারা অংশ নিয়েছিল তাদের বিচার না করা পর্যন্ত বাংলাদেশ নামের দেশটিই আসলে অসম্পূর্ণ থেকে যাবে, বিচার শেষ করার পর যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি দিয়ে আমরা এই গ্লানিময় অধ্যায়টিকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যাব। বারো-তেরো বছরের ছেলেমেয়েরা আর আমাকে চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করবে না, রাজাকাররা কেমন করে এই দেশে গাড়িতে ফ্ল্যাগ লাগিয়ে ঘুরে বেড়ায়? বরং আমি তাদের ডেকে ডেকে বলব, চল্লিশ-বিয়াল্লিশ বছর দেরি হলেও এ দেশের মাটিতে আমরা রাজাকারদের বিচার করেছি। দেশের মাটিটাকে পবিত্র করে ছেড়েছি! কথাগুলো বলতে গিয়ে আমার বুকটা কেমন করে ফুলে উঠবে সেটা চিন্তা করেই আমার বুকটা ফুলে উঠছে। আওয়ামী লীগ সরকার আমাকে সেই সুযোগটা দেবে তো?

২.
আমরা সবাই জানি এই দেশের সাথে সবচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল জামায়াতে ইসলামী। জার্মানিতে নাৎসি বাহিনী নেই, ইতালিতে ফ্যাসিস্ট বাহিনী নেই কিন্তু আমাদের দেশে কেমন করে জামায়াতে ইসলামী থেকে গেল? এখন আমরা সবাই জানি কেন এবং কেমন করে সেটা ঘটেছে। কিন্তু যেটা এখনো আমি বিশ্বাস করতে পারি না সেটা হচ্ছে সেই জামায়াতে ইসলামীর একটা ছাত্রসংগঠন আছে। মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা কেমন করে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন করে? কম বয়সী তরুণদের দেশ নিয়ে স্বপ্ন দেখার কথা, দেশের জন্য লাগামছাড়া ভালোবাসার আবেগে ডুবে যাওয়ার কথা, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অহংকার করার কথা, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে উচ্ছ্বাস করার কথা, পয়লা বৈশাখে রবীন্দ্রসংগীত গাওয়ার কথা, ছাব্বিশে মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে রক্ত গরম করার কথা, ষোলই ডিসেম্বর মাথায় লাল-সবুজ পতাকা বেঁধে পথে নেমে যাওয়ার কথা, একুশে ফেব্রুয়ারিতে ফুল নিয়ে শহীদ মিনারে প্রভাতফেরি করার কথা অথচ সেই বয়সের তরুণেরা এসব কিছু না করে কেমন করে দেশদ্রোহী বিশ্বাসঘাতক যুদ্ধাপরাধীদের নেতা হিসেবে মেনে তাদের আজ্ঞাবহ হয়ে কাজ করতে পারে? দেশকে ভালো না বেসে কেমন করে সেই দেশকে মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন থেকে ঠেলে সরিয়ে পাকিস্তান বানানোর চেষ্টা করতে পারে? আমি জানি আমি কখনোই এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাব না, কেউ যদি কিছু একটা উত্তর আমাকে দেওয়ার চেষ্টাও করে আমি সেটা বুঝতে পারব না! (বেশ কিছুদিন আগে খবরের কাগজে আমি এ রকম একটা কথা আরও একবার লিখেছিলাম, তখন একটা ছাত্র আমাকে এসএমএস করে জানিয়েছিল সে খুব ভালো ছাত্র এবং তার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু সে জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন শিবির করে কারণ তার বিভাগীয় প্রধান তাকে বলেছে তা না হলে সে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে পারবে না। আমি খোঁজ নিইনি, কাজেই জানি না শেষ পর্যন্ত সে শিক্ষক হতে পেরেছিল কি না!)
দীর্ঘদিন দেশের বাইরে থেকে চুরানব্বইয়ের শেষে আমি দেশে ফিরে এসেছিলাম। দেশে তখন বিএনপি সরকার, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংগঠনগুলোতেও বিএনপির ছাত্রসংগঠন ছাত্রদলের শক্তি বেশি। তাদের অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধের কথা অনেক বড় করে বলা হয়। একদিন এক অনুষ্ঠানে একজন রাজাকারদের বিদ্রূপ করে বক্তৃতা করেছে পরের দিন খবর পেলাম শিবিরের ছেলেরা তার পায়ের রগ কেটে দিয়েছে। দেশের বাইরে থাকতেই এই পদ্ধতির খবর পেয়েছিলাম, দেশে ফিরে এসে এই প্রথম আমার নিজের চোখে রগ কাটার ঘটনা দেখার অভিজ্ঞতা হলো। ছাত্রদলের ছেলেদের ভেতর দেশের জন্য তীব্র ভালোবাসা, মুক্তিযুদ্ধের জন্য গভীর মমতা এবং রাজাকারদের জন্য ভয়ংকর ঘৃণা। সেসব নিয়ে শিবিরের সাথে ছাত্রদলের ছাত্রদের প্রতিমুহূর্তে সংঘাত। বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার কিছুদিনের ভেতরেই আমাকে একটা তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হলো। রাজাকারদের নিয়ে কিছু একটা বলার জন্য শিবিরের একজন ছাত্রদলের একজনের পিঠে চাকু মেরেছে, সেটি নিয়ে তদন্ত করতে হবে। তদন্ত শেষ করার আগেই শিবিরের ছাত্রটি শুধু বিশ্ববিদ্যালয় নয়, দেশ পর্যন্ত ছেড়ে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে গেছে!
এভাবেই চলছিল, ঠিক তখন নিরানব্বই সালে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে খারাপ এবং দুর্ভাগ্যময় ঘটনাটি ঘটে গেল। ভোটের রাজনীতি করার জন্য বিএনপি আর জামায়াত একত্র হয়ে গেল। আমার মনে আছে ছাত্রদলের তরুণ ছেলেদের মাথায় রীতিমতো আকাশ ভেঙে পড়েছিল। তাদের কেউ কেউ আমার কাছে এসেছিল সান্ত্বনা পাওয়ার জন্য, শুকনো মুখে তারা আমাকে অনেক কথা বলেছে, আমি তাদের কিছু বলে সান্ত্বনা দিতে পারিনি। কমবয়সী তরুণ ছাত্ররা যেটা বুঝতে পেরেছিল, বিএনপির বড় বড় নেতা সেটা বুঝতে পারেনি। আমরা সবাই যেটি অনুমান করেছিলাম সেটি ঘটতে শুরু করল। নব্বইয়ের দশকের আধুনিক একটা রাজনৈতিক দল দেখতে দেখতে জামায়াতে ইসলামী ধাঁচের একটি দল হয়ে গেল। এই দেশের জন্য কত বড় দুর্ভাগ্য! কী দুঃখের কথা!

৩.
আমার ধারণা বিএনপির নেতারা খুব বড় একটা ভুল করেছেন, তাঁরা মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টাকে খাটো করে দেখেছেন, এই দেশের জন্য মুক্তিযুদ্ধ মোটেই খাটো একটা বিষয় নয়। এই দেশে অনেক মানুষ আছে যাদের আওয়ামী লীগ নিয়ে অ্যালার্জি আছে, তার মানে কিন্তু এই নয় যে তাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও অ্যালার্জি আছে! পঁচাত্তর থেকে নব্বই ছিল এই দেশের জন্য অন্ধকার সময়, সেই সময় এই দেশের প্রজন্মকে অন্ধকারে রেখে বড় করা হয়েছিল, দেশের ইতিহাস না জানিয়ে তাদের গড়ে তোলা হয়েছিল। সেই অন্ধকার সময় কিন্তু কেটে গেছে, আবার কিন্তু সেই সময় আর ফিরে আসবে না। এরপর প্রজন্মের পর প্রজন্মের জন্ম হয়েছে যারা দেশের সত্যিকারের ইতিহাসটুকু জানে। আমাদের ইতিহাসটুকু হচ্ছে আত্মত্যাগ, বীরত্ব আর অর্জনের ইতিহাস, তাই নতুন প্রজন্ম কিন্তু বড় হয়েছে মুক্তিযুদ্ধকে ভালোবেসে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে আত্মত্যাগ, বীরত্ব আর অর্জনের পাশাপাশি রয়েছে দেশদ্রোহী বিশ্বাসঘাতক আর যুদ্ধাপরাধীদের ইতিহাস, তাই নতুন প্রজন্ম বড় হচ্ছে জামায়াত শিবিরকে ঘৃণা করে। বিএনপি যখন সেই জামায়াত শিবিরকে আলিঙ্গন করে, নতুন প্রজন্মের কাছে সেটি কখনোই কিন্তু গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আমি নিশ্চিত বিএনপির ভেতরেও অসংখ্য নেতা-কর্মী রয়েছেন যাঁরা কোনো দিন জামায়াতে ইসলামীর সাথে জোট কখনো মেনে নেননি, মেনে নেওয়া সম্ভব না।
আমার ধারণা, বিএনপির ভেতরের এই নেতা-কর্মীরা আগে হোক পরে হোক মাথা তুলে দাঁড়াবে। ভোটের কথা বলে একসময় জামায়াতে ইসলামীর সাথে জোট করা হয়েছিল সেই ভোটের সংখ্যাই যদি কমে যায় তাহলে আদর্শকে কেন শুধু শুধু ছুড়ে ফেলা হবে? বাংলাদেশ এখন এমন একটি জায়গায় পৌঁছে গেছে যে মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করে কোনো দল আর এখানে রাজনীতি করতে পারবে না। (কেউ কি লক্ষ করেছে জামায়াতে ইসলামী ইদানীং স্বাধীনতা দিবস বা বিজয় দিবসে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কথা বলতে শুরু করেছে?) কাজেই আমার ধারণা, বিএনপি যদি জামায়াতে ইসলামীকে পরিত্যাগ না করে তাহলে আগে হোক পরে হোক তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আর বিপক্ষে এই দুই দলে ভাগ হয়ে যাবে। শুধু তা-ই নয়, আমার ধারণা বিএনপি দুই দলে ভাগ হয়ে যাওয়ার পর যে দলটি জামায়াত ঘেঁষা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী দল হিসেবে থাকবে সেই দলটি মুসলিম লীগের মতো দুর্বল থেকে দুর্বল হয়ে একদিন শেষ হয়ে যাবে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দলটি সত্যিকার একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে টিকে যাবে।
বিএনপির মতো এত বড় একটি রাজনৈতিক দল এই কথাগুলো জানে না সেটি হতে পারে না। তাই আমার কাছে খুব অবাক লাগে যখন দেখি তারা এই দেশের মানুষের বুকের ভেতর জমে থাকা দেশ নিয়ে তীব্র আবেগটুকু অনুভব করতে পারে না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি না করে তারা বিচারের বিরুদ্ধে এক শ রকম কুযুক্তি দাঁড় করাতে চায়। কী আশ্চর্য!

No comments:

Post a Comment

আরো জানুন

সম্পর্কে